পহেলা বৈশাখ হিন্দুয়ানি উৎসব কি না এবং তা পালন করা হারাম কি না—এই তুলকালাম আলাপের মধ্যেই জেনে নিই বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পহেলা বৈশাখের প্রকৃত ইংরেজি তারিখ আসলে কবে? ১৪ই এপ্রিল নাকি ১৫ই এপ্রিল? বাংলাদেশে অনেকেই ১৪ই এপ্রিলে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আর এ দেশের প্রায় সব হিন্দু ও কিছু হিন্দুয়ানি মুসলমান পহেলা বৈশাখ পালন করে ১৫ই এপ্রিল।
কেন?
এর কারণ এটা নয় যে হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গকে তাদের ঠাকুরঘর মনে করে। এর কারণ এটা, যখনই বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন সেই চিন্তায় সাতচল্লিশে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে না যাওয়া মানুষগুলোর কথা থাকে না, কোনো দিনই থাকেনি৷
এত বড় একটা অভিযোগ কেন? এটি কোনো মনগড়া বা স্বপ্নে পাওয়া কথা নয়। ইতিহাস আছে এর।
এই ভূখণ্ডের মানুষ সম্রাট আকবর আসারও আগে চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান বুঝেই তাদের প্রাত্যহিক কর্মের সিদ্ধান্ত নিত৷ গ্রহ-নক্ষত্রভিত্তিক যে বর্ষপঞ্জি তারা অনুসরণ করত, তার নাম শকাব্দ৷ সেটি মৌর্য আমল থেকে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। আকাশের কোন নক্ষত্র কোন অবস্থানে থাকবে, তা অনু-দণ্ড-পল হিসাব করতে নক্ষত্রবিজ্ঞানের প্রয়োজন। প্রাচীন ভারতবর্ষ যে নক্ষত্রবিজ্ঞানে প্রাজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখেছে হাজার হাজার বছর আগে, তা তো বিজ্ঞানের ইতিহাসই বলে। দাঁড়ান, ভারতবর্ষ শুনে পালাবেন না। অঙ্গ, বঙ্গ অথবা মগধের ইতিহাসে আপনার-আমার সবার পূর্বপুরুষই আছে। কারণ, আজকের যে বাঙালি, তার পূর্বপুরুষ এই ভূখণ্ডের। এই দক্ষিণ এশিয়ার উর্বর মাটি তাদের শিকড়। ভারত উপমহাদেশেই তাদের হাজার বছরের ইতিহাস। কোনো পাথুরে মাটির মরুভূমিতে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়নি। তাই, প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তরাধিকার আপনারও আছে। আছে বলেই হিন্দুয়ানিকে গালি দেওয়ার প্রকাণ্ড ওয়াজটি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি বা অন্য কোনো অবাংলা ভাষায় কুলিয়ে উঠতে পারা যায় না!) বাংলাকে ছোট করতে বাংলা ভাষাই লাগে। বাঙালি জাতিসত্তাকে অস্বীকার করতে হয় এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়েই।
যেখানে ছিলাম। কেমন সেই নক্ষত্র বিচার দিয়ে করা বর্ষপঞ্জি? উদাহরণ দিই। এই যেমন গতকাল ছিল ৩০শে চৈত্র, ১৩ই এপ্রিল। গতকাল ছিল শুক্লপক্ষের প্রতিপদ। অশ্বিনী নক্ষত্র গতকাল রাত ২টা ১ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড থেকে আজ ভোর ৬টা ৪১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত পৃথিবীর সঙ্গে উপবৃত্তাকারে অবস্থান করেছে এবং তারপর এসেছে ভরণী নক্ষত্রের পালা। শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি ও চৈত্রের ৩১তম দিন। নক্ষত্র আর গ্রহের এই অবস্থান থেকে শুধু বাংলা মাসের নাম আসেনি, বাংলা দিনের নামও এসেছে। মিলিয়ে দেখুন। পহেলা বৈশাখকে নাহয় হিন্দুয়ানি বলে এড়াবেন। কিন্ত শুক্র, শনি, রবি, মঙ্গল বা বৃহস্পতিবারকে এড়াবেন কী করে? এরা সবাই-ই তো নক্ষত্রের জাতক। শুধু কি বাংলায়? ইংরেজির কথাই ধরুন। Saturday (Saturn-শনি গ্রহ), Sunday (Sun- সূর্য), Thursday (Jupitar – বৃহস্পতি গ্রহ) ইত্যাদি। গ্রহ-নক্ষত্র থেকেই তো এসেছে। বাংলা ১২টি মাসের নাম, ৬টি ঋতুর নাম, এমনকি ইংরেজি ১২টি মাসের নাম এবং ঋতুগুলোর নামের উৎসও কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের কারণেই হয়েছে। শুধু কি তা-ই? হিজরি মাসগুলোর নামকরণও কিন্তু এই একই কারণেই। আকাশে গ্রহ, নক্ষত্র ও চাঁদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে।
তো, এই নক্ষত্র ও গ্রহের অবস্থানভিত্তিক বর্ষগণনা পদ্ধতি কি হাজার বছর ধরে অবিকৃত? না৷ বহুবার এর সংস্কার হয়েছে। নক্ষত্রবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভুল সংশোধন করা হয়েছে প্রয়োজনমতো। এই মুহূর্তে যে নক্ষত্রভিত্তিক বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়, তার বয়স ১৯৪৩ বছর৷ অর্থাৎ আজ শকাব্দ ১৯৪৪, বঙ্গাব্দ ১৪২৯। সংশোধিত এই বর্ষপঞ্জি হিজরি সাল প্রবর্তনের ৫০০ বছর আগের৷ সম্রাট আকবর যে ফসলি সাল সংস্কার করেন, তার বয়স ১৪২৯ বছর, সেটা আসলে শকাব্দ আর হিজরি সাল মিলিয়ে। যার মানে, বর্তমানে যে বিশুদ্ধ পঞ্জিকায় বাংলা বছর অনুসরণ করা হয়, তাতে হিন্দু-মুসলিম দুইয়েরই ভাগ আছে। এটা বাঙালি হিন্দুর একার নয়।
তাহলে, বাংলা সাল হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই যদি হবে, তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু কেন ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করে না? এরও আছে গল্প।
১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে মেঘনাদ সাহা বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে শকাব্দের সমন্বয় আরও সংশোধন ও সূক্ষ্মতানয়ন করেন।এপারে ১৯৬৩ সালে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও বাংলা সালগণনায় কিছু সংস্কার করেন৷ আমরা জানি, নক্ষত্রভিত্তিক দিনগণনার পদ্ধতিতে একটি মাস ৩২ দিনেও হতে পারে। যেমন শ্রাবণ মাস প্রায়ই ৩২ দিনে হয়। কারণ, শ্রবণা নক্ষত্রের আয়তনের কারণে পৃথিবীর সঙ্গে তার সরণে সময় লাগে৷ আবার পূষ্যা নক্ষত্রের সরণভেদে পৌষ মাস ২৯ দিনেরও হয়। তবে বছরের মোট দিন ৩৬৫-ই থাকে। প্রতি চার বছরে নক্ষত্রের সরণ বিচারে কোনো কোনো মাসের এক দিন বর্ধিত হয় (ইংরেজি অধিবর্ষ তত্ত্বের কাছাকাছি ব্যাপার)। কোন বছর কোন মাস কত দিনের হবে, তা নক্ষত্রের পল ও দণ্ডের অবস্থান বুঝেই হিসাব করা হয়। এ কারণেই হিন্দু বাড়িগুলোয় ঠিক খ্রিষ্ট ক্যালেন্ডারে সব তারিখ বিচার হয় না। একটা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তের পঞ্জিকাও লাগে। যেমন- নবযুগ হাফ পঞ্জিকা, বেনীমাধব শীল ফুল পঞ্জিকা, লোকনাথ ডাইরেক্টরি। এসব পঞ্জিকায় নক্ষত্র বিচার করে বাংলার সঙ্গে হিজরি সালের নির্ভুল গণনাও থাকে।
কিন্ত ভাষাবিদ ডক্টর মু. শহীদুল্লাহ্ এই নক্ষত্রভিত্তিক চর্চা অস্বীকার করে যে বাংলা ক্যালেন্ডার করেন, তাতে কেবল হিসাবের সুবিধার জন্য বাংলা বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনের আর পরের সাত মাস ৩০ দিনের হবে বলে ঠিক করেন। অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামানোর আর প্রয়োজন ও ঝামেলা রইল না৷ স্রেফ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের নিচে আঙুলের কর গুনে বাংলা তারিখ বসিয়ে দেওয়া। তাতে যে বাংলা পঞ্জিকা মেনে চলা মানুষগুলোকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে, সেটা আর কেউ ভাবলই না। তখন তো আর সংখ্যায় ৮% ছিল না তারা। তবু ভাবা হয়নি। কারণ, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ, কেউই তার সংখ্যালঘুদের কথা ভাবার প্রয়োজন নিজের শেকড়ে অনুভব করেনি কোনোকালে। পৃথিবীর সব ক্যালেন্ডারেরই একটা কিছু ইতিহাস বা প্রেক্ষাপট আছে। বাংলাদেশি বাংলা ক্যালেন্ডারটির ভিত্তি শুধু খামখেয়ালি আর গায়ের জোর! এর ফলেই একটা উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী, যাদের জন্ম- মৃত্যু-বিয়ে- প্রার্থনা সবকিছু নক্ষত্রের নিয়ম মেনে চলে, তাদের কথা না ভেবেই বাংলা বছরের একটা কৃত্রিম হাস্যকর সংস্করণ এল। বলা চলে, খুব ভেবে অথবা কিছুই ভাবার দরকার নেই মনে করেই একটা জনগোষ্ঠীকে একঘরে করে দেয়া হলো একধাক্কায়৷ পহেলা বৈশাখ হয়ে গেল একটা নির্দিষ্ট খ্রিষ্টীয় তারিখে। কেন? বাংলা তারিখ ও বাঙালির দিন গণনা এবং উৎসব কেন খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হবে? বাঙালির তো নিজস্ব হাজার বছর আগের সমৃদ্ধ দিনপঞ্জিকা আছেই। অথচ এই দেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বেই প্রতিবছর দুটো ইদ, রোজা, দুর্গা পূজা, অন্যান্য পূজা-পার্বণ, শবে বরাত, জন্মাষ্টমী, বুদ্ধ ও মাঘী পূর্ণিমা, কোজাগরী এবং প্রবারণা উৎসবও কিন্তু হয় চাঁদ ও গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব অনুযায়ী। একমাত্র বাংলার বর্ষগণনাটাই হয়ে গেল বারোয়ারি একটা ইংরেজি তারিখমাত্র।
কাহিনি এখানেই শেষ নয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালের সংশোধিত সেই বাংলা ক্যালেন্ডার খুব বড় প্রভাব না রাখলেও ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ডক্টর মু. শহীদুল্লাহর ক্যালেন্ডার অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে নির্ধারিত ক্যালেন্ডারটিই নিল৷ আর ১৯৯৫ সালে ঠুকে দেওয়া হলো শেষ পেরেক। তৎকালীন এরশাদ সরকারের পরামর্শ নিয়ে বাংলা একাডেমি শুধু বাংলা ক্যালেন্ডার আরেকবার সংস্কার করল, যাতে ইংরেজি ঐতিহাসিক তারিখের মতো বাংলা তারিখও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো৷ ফলে কী সর্বনাশটা হলো জানেন? আপনি যখন কবিতায় পড়ছেন, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুরবেলার অক্ত’, সেদিন ছিল ফাল্গুনের আট তারিখ। ১৯৯৫ সালের ক্যালেন্ডারে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো যে ২১শে ফেব্রুয়ারি মানে ৯ই ফাল্গুন। পহেলা বৈশাখ মানে ১৪ই এপ্রিল, এটাই নির্দিষ্ট।
অতএব, আজ যারা পহেলা বৈশাখ পালন করতে চান, তারা নির্ভয়ে করুন। ১৪ই এপ্রিলের পহেলা বৈশাখ নির্ভেজাল মেড ইন পাকিস্তান ও এসেম্বেল্ড ইন বাংলাদেশ। সারা পৃথিবীর প্রকৃত বাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সব বাঙালি, এ দেশের সব পাহাড়ি আদিবাসী ও উপজাতি বাঙালিরা এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ হিন্দু গতকাল ফুলবিষু পালন করছে। আজ চৈত্রসংক্রান্তি পালন করছে। নখ কেটে কাঁচা হলুদবাটা মেখে স্নান করছে। আজ সকালে আট পদের ফলার খেয়েছে। দুপুরের খাবার চৌদ্দ শাক আর পাজন৷ তার আগে ভোরবেলা বিষকাটালির ডাল পুড়িয়ে, সেই ধোঁয়া যত দূর সম্ভব ছড়িয়ে দিয়ে বলতে হয়, পুরাতন বছরের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সব অশুভ শক্তি দূর হোক! নতুন বছরে মঙ্গল হোক জগতের।
জানেন? যতক্ষণে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৪ই এপ্রিল পেরিয়ে গিয়ে ১৫ই এপ্রিল এসে যাবে, বাংলা একাডেমির ক্যালেন্ডারে হবে ২রা বৈশাখ; ততক্ষণে ভরণী নক্ষত্র পৃথিবীর সঙ্গে দক্ষিণ কোণে ৫৪ পল ২১ অনুপল ও ৫৩ দণ্ডে রাত্রি ৩টা ৩৬ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড পর্যন্ত অবস্থান করার পর কৃত্তিকা ও বিশাখার অমৃতযোগে শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে ১৯৪৩ শকাব্দের ও ১৪২৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি শুরু হবে।
অতএব, নির্ভাবনায় সম্রাট আকবর, মেঘনাদ সাহা ও প্রাচীন নক্ষত্রবিজ্ঞানের হিন্দুয়ানি স্পর্শমুক্ত খাঁটি বাংলাদেশি বাংলা নববর্ষ পালন করুন৷
শুভ নববর্ষ৷
(সংকলন ও গ্রন্থনা: অনন্যা গোস্বামী, সাংবাদিক, কবি ও আবৃত্তিশিল্পী)
কপি করলে খবর আছে