ভালো নেই নীলফামারী মৃৎশিল্পের কারিগররা!

লেখক: ময়নুল হক, নীলফামারী থেকে
প্রকাশ: ১২ মাস আগে

মাটির সঙ্গে এ গ্রামের মানুষের গভীর সম্পর্ক। কিন্তু এই মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। প্রযুক্তির যুগে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসের জায়গা দখল করেছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। সে কারণে বাজারে মাটির তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই। তবুও মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা তাদের কর্মদক্ষতার দ্বারা এই শিল্পটাকে আঁকড়ে ধরে এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন।

নীলফামারী শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের সোনারায় ইউনিয়নের উত্তর মুসরত কুকাপাড়া গ্রাম। ওই গ্রামের প্রায় ৬৫টি পরিবার জীবন ও জীবিকার তাগিদে মৃৎশিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর ধরে। এছাড়া জেলায় বিছিন্নভাবে আরও ২৩০টি পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত। কিন্ত মাটির অভাব, প্রয়োজনীয় পুঁজি ও পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন তারা।

মাটির তৈরি এসব সামগ্রীর ন্যায্যমূল্য না থাকায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এরপরও কিছু পরিবার এই পেশা আঁকড়ে ধরেই কম বেশি যা আয় করছেন তা দিয়েই পরিবারসহ টিকে রয়েছেন। এসব পরিবারের অধিকাংশেরই মাঠে কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। বসতভিটার মাত্র দুই এক কাঠা জমিই তাদের শেষ সম্বল।

বাড়ির উঠানে কিংবা পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরি করছে গ্রামের মানুষ। কেউ তৈরি করছেন মাটির পুতুল, ঘোড়া, গরু, হাতি, ময়ূর, খেলনা, কেউ আবার তৈরি করছেন হাঁড়ি, পাতিল, থালাসহ বিভিন্ন প্রকার সামগ্রী। আবার রং-তুলি দিয়ে সেসব সামগ্রী দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করে তুলছেন কেউ কেউ। বিভিন্ন আকার ও শৈলীতে তৈরি হচ্ছে এসব পণ্য। যুগ যুগ ধরে মাটি দিয়ে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করে আসছেন তারা।

সেখানকার একাধিক বাসিন্দা জানান, সকাল থেকে শুরু হয় এসব পণ্য তৈরির কাজ। এরপর রোদে শুকানো ও রং-তুলির সাহায্যে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। নারী-পুরুষরা সমানতালে এই কাজ করেন। তাদের সহযোগিতা করেন ছেলেমেয়েরাও।

বাড়ির উঠানে বসে কাজ করছিলেন নমিতা পাল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাপ-দাদার হাতে এসব শিখছু। এখন স্বামীর সংসারে ২১ বছর ধরি এই কাম করি। স্বামী, বেটি দুইটা, বেটা একটা ওমরাও এই কামই করে। তাও সংসার চলে না।’

আরও পড়ুন : পঞ্চগড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের স্বাক্ষর জাল করে সরকারি দপ্তরে চিঠি; আটক-১

স্থানীয় খগেন্দ্র পাল বলেন, ‘প্লাস্টিকের ভাড়া পাতিল বের হয়ে হামার মাটির জিনিস কেউ নেয় না। বছরে একবার পহেলা বৈশাখ, হিন্দুর বিয়া বাড়ি ও বিভিন্ন পূজার সময় একটু বেচাকেনা হয়। অন্য সময় তাও হয় না। এক সময় এই ব্যবসার যথেষ্ট কদর ছিল। বাড়িতে এসে পাইকাররা বায়না দিয়ে যেত। এখন আর সেই দিন নাই। আগে কামাই খুব হইত। কিন্তু এখন পেটই চলে না।’

একই গ্রামের মৃৎশিল্পী বিকাশ চন্দ্র পাল বলেন, পুরুষদের প্রধান কাজ মাটি কিনে সেগুলো কাদা করা ও ভাটায় পোড়ানো। এরপর এসব সামগ্রী নিজ হাতে তৈরি করেন বাড়ির নারী ও ছেলে মেয়েরা। আর এসব তৈরি সামগ্রী বাজারে বিক্রি করি আমরা। কিন্ত দিন দিন চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন হাত পড়েছে কপালে।

মাটির সামগ্রী বিক্রি করা কৈলাস চন্দ্র পাল বলেন, মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলস, সারোয়া, পেচি, তাওয়ার এক সময় খুব চাহিদা ছিল। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতা সামলানোই কষ্টকর ছিল। এখন হাটে আসা যাওয়ার ভ্যান ভাড়াই তুলতে পারি না। আগে গরমে পানি রাখার একটি কলস বিক্রি হতো ৩০-৪০ টাকা। এখন ফ্রিজ বের হয়ে কলসের কোনো চাহিদা নাই। হঠাৎ এক-দুইটা বিক্রি হয়, তাও পানির দামে দিতে হয়।

সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মঞ্জুর মোর্শেদ তালুকদার বলেন, কুমারপাড়ার ওই পরিবারগুলো বিছিন্নভাবে বসবাস করায় তাদের কোনো সমবায় সমিতি নেই। তাদের এক জায়গায় করে সমবায় সমিতির মাধ্যমে সহযোগিতা করা যেতে পারে। প্লাস্টিকের উৎপাদিত পণ্যের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মৃৎশিল্প।

জেলা বিসিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক হোসনে আরা খাতুন বলেন, এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সমিতির মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহায়তা করা যেতে পারে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের আদলে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে প্লাস্টিক পণ্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিনিয়ত ব্যবহার কমছে মাটির তৈরি পণ্যের। এতে বিপাকে পড়েছেন এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা। তবে আমাদের শর্ত পূরণের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে কোনো ধরনের সহায়তার সুযোগ থাকলে তা অবশ্যই করা হবে। এটি গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন এখানকার মৃৎশিল্পীরা।

ডেস্ক/বিডি

  • খেলনা
  • গরু
  • ঘোড়া
  • মাটির পুতুল
  • মৃৎশিল্পের কারিগররা!
  • ময়ূর
  • হাতি
  •    

    কপি করলে খবর আছে